শুক্রবার, ০৯ মে ২০২৫

| ২৬ বৈশাখ ১৪৩২

Campus Bangla || ক্যাম্পাস বাংলা

ডেঙ্গু সংকট মোকাবিলায় যথাযোগ্য রাজনৈতিক ও সরকারি প্রাধান্য দেওয়া হয়নি: টিআইবি

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৮:২২, ৩০ অক্টোবর ২০২৩

ডেঙ্গু সংকট মোকাবিলায় যথাযোগ্য রাজনৈতিক ও সরকারি প্রাধান্য দেওয়া হয়নি: টিআইবি

সুনির্দিষ্ট পূর্বসতর্কতা ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আন্তর্জাতিক মানের দিকনির্দেশনা এবং কর্মপরিকল্পনা থাকা সত্ত্বেও ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে পর্যাপ্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। পাশাপাশি, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব এড়ানোর অনৈতিক ও অমানবিক প্রবণতার কারণে সারাদেশে সর্বাধিক মৃত্যু ঘটেছে। একইসঙ্গে, ডেঙ্গু সংকট মোকাবিলায় ব্যর্থতার দায় অনৈতিকভাবে জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। ৩০ অক্টোবর, সোমবার “ডেঙ্গু সংকট প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ” শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে নানা ঘাটতির পাশাপাশি ডেঙ্গু চিকিৎসায় নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে টিআইবির গবেষণায়। এডিস মশা ও ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে সুশাসন নিশ্চিতে ২১ দফা সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।

ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তি তথা নারী ও বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি-বিষয়ক কার্যক্রম বা চিকিৎসা সেবার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ গ্রহণে ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। অন্যদিকে, জনস্বাস্থ্য সংকটকে কাজে লাগিয়ে দুর্নীতি ও অনিয়মের ঘটনা উঠে এসেছে গবেষণায়।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মুহাম্মদ বদিউজ্জামান। প্রতিবেদনটি উপস্থাপনা করেন টিআইবির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো মো. জুলকারনাইন এবং রিসার্চ ফেলো রাজিয়া সুলতানা।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ডেঙ্গুর প্রকোপ ধারাবাহিকভাবে সারা বছরব্যাপী বিদ্যমান থাকলেও এই রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক ও সরকারিভাবে পর্যাপ্ত গুরুত্ব প্রদান করা হয়নি। বাংলাদেশে ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কৌশলপত্র ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ও বিদ্যমান আইন অনুসরণ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকর্তৃক সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮ অনুসরণ, যথাযথ সাড়া প্রদান, ডেঙ্গু সংক্রমণ চিহ্নিকরণ ও সমন্বিত ডাটাবেজ প্রণয়ণ, মশা নিধন কার্যক্রমে সক্ষমতা, অংশীজনদের ভ‚মিকা ও সমন্বয়ে ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। একইসঙ্গে, ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় নিজেদের মধ্যে সমন্বয় না করে যার যার মতো কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

মশা নিধনে দায়িত্বরত মাঠ কর্মীদের ১০০-৫০০ টাকা দিলে বাড়িতে গিয়ে “অধিক কার্যকর” ওষুধ দিয়ে আসার অভিযোগ যেমন পাওয়া যায়, তেমনি ই-জিপির মাধ্যমে ওপেন টেন্ডারিং এর কিছু ক্ষেত্রে “সিঙ্গেল বিডিং” এর প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়।

গবেষণার আওতাভুক্ত ১০ টি জেলার মাঠ-পর্যায় থেকে সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সকল সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম এখনও শুধুমাত্র রাসায়নিক পদ্ধতির (লার্ভিসাইড ও অ্যাডাল্টিসাইড) মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। কিছু কিছু এলাকায় পাবলিক প্লেসে মশার প্রজনন স্থল ধ্বংস করা হলেও এখনও ঘরে ঘরে মশার প্রজনন স্থল চিহ্নিতকরণ ও ধ্বংস করার কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই।

মাঠ পর্যায় থেকে সংগৃহীত তথ্যের বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, কোনো কোনো এলাকায় ৫ থেকে ২৭ বছর ধরে একই কীটনাশক ব্যবহৃত হচ্ছে। কীটতত্তবিদ ও জনস্বাস্থ্য গবেষকদের মতে একই কীটনাশক বহু বছর ধরে ব্যবহারের ফলে মশা কীটনাশক সহনশীল হয়ে যায় এবং ঐ কীটনাশক প্রয়োগে মশা নিধন হয় না। কোনো কোনো এলাকায় কীটনাশকের কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয় না। আবার অনেক এলাকায় কীটনাশকের কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হলেও সেখানে কীটতত্তবিদ ও বিশেষজ্ঞদের কোনো সম্পৃক্ততা থাকে না। অন্যদিকে, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক স্বপ্রণোদিতভাবে তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।

অন্য দেশ থেকে আমরা ভালো করছি, আমাদের উদ্বেগের কারণ নেই- সংসদে এমন কথা বলে আত্মতুষ্টিমূলক প্রচারণাও চালানো হয়েছে। সর্বোপরি, ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি যথাযথ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রাধান্য পায়নি। একইসঙ্গে সমন্বয়হীনতার প্রকট উদাহরণও সৃষ্টি হয়েছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক ও উদ্বেগজনক : ড. ইফতেখারুজ্জামান।

গবেষণায় আরো দেখা যায়, ডেঙ্গু চিকিৎসা ব্যবস্থায় সক্ষমতার ঘাটতি ছিলো প্রকট। বাংলাদেশে মোট ডেঙ্গু মৃত্যুর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে ষাটোর্ধ্ব বয়সী ব্যক্তিদের (১৯%)। এ ছাড়া আক্রান্তের সংখ্যা অনুপাতে ষাটোর্ধ্ব বয়সী ব্যক্তিদের মৃত্যু হার অনেক বেশি। ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তি তথা নারী ও বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি-বিষয়ক কার্যক্রম বা চিকিৎসা সেবার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ গ্রহণে ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। অন্যদিকে, জনস্বাস্থ্য সংকটকে কাজে লাগিয়ে দুর্নীতি ও অনিয়মের ঘটনা উঠে এসেছে গবেষণায়। মশা নিধনে দায়িত্বরত মাঠ কর্মীদের ১০০-৫০০ টাকা দিলে বাড়িতে গিয়ে “অধিক কার্যকর” ওষুধ দিয়ে আসার অভিযোগ যেমন পাওয়া যায়, তেমনি ই-জিপির মাধ্যমে ওপেন টেন্ডারিং এর কিছু ক্ষেত্রে “সিঙ্গেল বিডিং” এর প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। একটি কীটনাশক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ওপেন টেন্ডারিং এর মাধ্যমে তিনটি সিটি কর্পোরেশনের ১৬টি ক্রয়াদেশ পায়, যার মধ্যে সাতটিতে একক বিডার হিসেবে টেন্ডারে অংশগ্রহণ করে প্রতিষ্ঠানটি। ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও অনিয়ম-দুর্নীতি পরিলক্ষিত হয়েছে। বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ১০০ টাকার শিরায় দেওয়া স্যালাইন ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা হয়েছে। আবার, ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু পরীক্ষার সুবিধা অপ্রতুল ছিল।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে প্রস্তাবিত কৌশল, দিকনির্দেশনা এবং কর্মপরিকল্পনা থাকলেও, বাংলাদেশে ডেঙ্গু মোকাবিলায় তার প্রতিফলনের কোনো দৃষ্টান্ত আমরা দেখিনি। অন্যদিকে, ডেঙ্গু মোকাবিলায় অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা, এমনকি কোভিড সংকটসহ জনস্বাস্থ্যবিষয়ক নিজস্ব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো হয়নি। সকল অংশীজনকে অন্তর্ভুক্ত করে কোভিড সংকট মোকাবিলা করার অভিজ্ঞতার প্রতিফলনও আমরা ডেঙ্গু মোকাবিলায় দেখতে পারিনি। সংশ্লিষ্ট সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান দায়সারাভাবে ভূমিকা পালন করেছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে গ্রহণই করতে চায়নি। “অন্য দেশ থেকে আমরা ভালো করছি এবং আমাদের উদ্বেগের কারণ নেই” সংসদে এমন কথা বলে আত্মতুষ্টিমূলক প্রচারণাও চালানো হয়েছে। সর্বোপরি, ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি যথাযথ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রাধান্য পায়নি। একইসঙ্গে সমন্বয়হীনতার প্রকট উদাহরণও সৃষ্টি হয়েছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক ও উদ্বেগজনক।’