সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫

| ১ পৌষ ১৪৩২

Campus Bangla || ক্যাম্পাস বাংলা

অবৈধভাবে মাছ ধরার কারণে হারিয়ে যাচ্ছে মাছের প্রাকৃতিক সম্পদ

মোস্তাক আহমেদ

প্রকাশিত: ১৯:০৯, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫

অবৈধভাবে মাছ ধরার কারণে হারিয়ে যাচ্ছে মাছের প্রাকৃতিক সম্পদ

বাংলাদেশের উপকূল ও বঙ্গোপসাগর আমাদের জন্য এক বিশাল আশীর্বাদ। এ সাগর আমাদের অর্থনীতি, খাদ্য নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থানের অন্যতম প্রধান উৎস। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে মাছের অঢেল ভান্ডার বঙ্গোপসাগরই সংকটে। অবৈধভাবে মাছ ধরার কারণে দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে মাছের প্রাকৃতিক সম্পদ, যা আমাদের ভবিষ্যৎকে গভীর ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।

২০০৭-০৮ সালের দিকে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ যেমন রূপচাঁদা, ম্যাকেরেল, কুইন ফিশ, চিংড়ি, লইট্টা, রূপসা ও ইল ফিশ বিদেশে রপ্তানি করে দেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছিল। সেই সময়ে সামুদ্রিক মাছ ছিল আমাদের অন্যতম রপ্তানি আয়ের উৎস। হাজার হাজার মানুষ এই খাতের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিল-জেলে, ব্যবসায়ী, প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান।

আমদানি করা সামুদ্রিক মাছ তুলনামূলকভাবে সস্তা হওয়ায় এগুলো দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বিক্রি হচ্ছে। দরিদ্র মানুষ অন্তত এই আমদানি করা মাছ কিনে কিছুটা হলেও প্রোটিন পাচ্ছে, যা এক ধরনের ইতিবাচক দিক হলেও সামগ্রিকভাবে এটি আমাদের সামুদ্রিক অর্থনীতির দুরবস্থা নির্দেশ করে।

কিন্তু বর্তমানে সেই গৌরবময় অবস্থান আমরা হারিয়ে ফেলছি। গভীর সমুদ্রে কিছু ট্রলার উন্নত সোনার মেশিন ব্যবহার করে নির্বিচারে মাছ শিকার করছে। তারা পানির নিচে গিয়ে ছোটবড় সব ধরনের মাছ ধরে ফেলছে, এমনকি অনেক সময় সমুদ্রের তলদেশের কাদা পর্যন্ত তুলে ফেলছে। ফলে মাছের প্রজনন ব্যাহত হচ্ছে, সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে এবং সমুদ্রের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। বিশেষ করে উদ্বেগজনক হলো সামুদ্রিক জাল ও সোনার ব্যবহার করে ছোট ছোট মাছ ধরা হচ্ছে-এ ধরনের মাছগুলোকে স্থানীয়ভাবে ‘ট্র্যাশ ফিশ’ বলা হয়ে থাকে।

ট্র্যাশ ফিশ সরাসরি মানুষের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার না করে বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে আবর্জনা বা জেগে ওঠা মাছ হিসেবে এবং বড় পরিমাণে এগুলো মাছের খাবার তৈরির কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। সমুদ্রের তলদেশ থেকে কাদা তুলে এনে ট্র্যাশ ফিশসহ অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় বস্তু মিশিয়ে ধরা হলে তা পরিবেশগতভাবে সংকোচন ঘটায় এবং মাছের প্রজননের জন্য জরুরি প্রাকৃতিক আবাসস্থল ধ্বংস করে।

এ অবৈধ মাছ ধরার ফলে আজ বাংলাদেশের সামুদ্রিক মাছের সরবরাহ এতটাই কমে গেছে যে এখন আমাদের দেশকে বিভিন্ন দেশ যেমন ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, উরুগুয়ে, চীন ও জাপান থেকে প্রতি বছর লাখ লাখ টন মাছ আমদানি করতে হচ্ছে। আগে যেখানে আমরা প্রচুর মাছ বিদেশে রপ্তানি করতাম, এখন সেখানে আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছি।

আমদানি করা সামুদ্রিক মাছ তুলনামূলকভাবে সস্তা হওয়ায় এগুলো দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বিক্রি হচ্ছে। দরিদ্র মানুষ অন্তত এই আমদানি করা মাছ কিনে কিছুটা হলেও প্রোটিন পাচ্ছে, যা এক ধরনের ইতিবাচক দিক হলেও সামগ্রিকভাবে এটি আমাদের সামুদ্রিক অর্থনীতির দুরবস্থা নির্দেশ করে। কারণ যে দেশ একসময় মাছ রপ্তানি করত, আজ সে দেশই বিদেশি মাছের ওপর নির্ভরশীল।

সরকার কিছু নির্দেশনা ও নীতিমালা গ্রহণ করলেও মাঠপর্যায়ে সেগুলো যথাযথভাবে প্রয়োগ হচ্ছে না-নজরদারি ততটা কড়া নয় এবং কিছু ক্ষেত্রে আইন অমান্য করলেও দ্রুত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এই অনিশ্চয়তা রপ্তানিকারক, জেলে ও প্রক্রিয়াজাতকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে অবিশ্বাস তৈরি করেছে। অনেক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান কাঁচামালের সংকটের মুখে তাদের কার্যক্রম স্থগিত বা বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে এবং কিছু প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা বন্ধের পথে। এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন কৌশলগত ও সমন্বিত পদক্ষেপ কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ, অবৈধ ট্রলিং নিয়ন্ত্রণ, সোনার ব্যবহারের ওপর সীমাবদ্ধতা, জেলেদের জন্য বিকল্প উপার্জনের ব্যবস্থা ও প্রশিক্ষণ এবং স্থানীয় পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধির কর্মসূচি। পাশাপাশি বাজার পর্যবেক্ষণ ও ট্র্যাশ ফিশের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে নিশ্চিত করতে হবে যে এগুলো মানুষের খাবার চেইনকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে না। যদি আমরা এখনই উদ্যোগ না নিই, তবে শুধু জেলেদের নয়, সমগ্র সামুদ্রিক শিল্প এবং দেশের রপ্তানি খাতকেই বড় সংকটের মুখে পড়তে হবে। অতীতে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার সাফল্য পুনরুদ্ধার করা সম্ভব, যদি আমরা টেকসই ও মনোযোগী নীতি গ্রহণ করি। বঙ্গোপসাগর শুধুই আমাদের সম্পদ নয়-এটি আমাদের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক পরিচয়ের অংশ। তাই এখনই সময় সচেতন হওয়ার, কঠোর নিয়ন্ত্রণ আর সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া যাতে আগামী প্রজন্ম ও জাতীয় অর্থনীতি এই জীববৈচিত্র্যের সুফল ভোগ করতে পারে। আমাদের সমুদ্র, আমাদের ভবিষ্যৎ-একে রক্ষা করা আমাদের সবারই কর্তব্য।

লেখক : পরিচালক, ফিশ ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন

"এই বিভাগে প্রকাশিত মুক্তমতের সকল দায়ভার লেখকের নিজের। ক্যাম্পাস বাংলা কোনভাবেই এই বিভাগের লেখক কিংবা লেখার বিষয়বস্তুর দায়ভার নিচ্ছে না।"