শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪

| ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

Campus Bangla || ক্যাম্পাস বাংলা

ইবি ভিসি সালামের অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে ইউজিসি

ক্যাম্পাস ডেস্ক

প্রকাশিত: ০৯:৩৪, ৩০ এপ্রিল ২০২৪

ইবি ভিসি সালামের অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে ইউজিসি

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেট, ইনসেটে উপাচার্য

কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) যেন লাগামছাড়া দুর্নীতি-অনিয়মের কারখানা। আর এসব অনিয়মের নেপথ্যে রয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. শেখ আবদুস সালাম। অনিয়ম-দুর্নীতি, নিয়োগ বাণিজ্য ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ এনে বিভিন্ন সময় তার বিরুদ্ধে আন্দোলনও করেছেন শিক্ষকরা।

আন্দোলনের মুখে অভিযোগের তদন্ত করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) উপাচার্যের অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয়ে সুপারিশও করেছে। এমনকি দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে উপাচার্য নিজের পদে বহাল থাকার নৈতিক অধিকার হারিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। 

তদন্ত শেষে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সুপারিশসহ প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয় পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে।

- অধ্যাপক মুহাম্মদ আলমগীর, চেয়ারম্যান, ইউজিসি।

প্রসঙ্গত ২০২০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক শেখ আবদুস সালাম। নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন তিনি। তার বিরুদ্ধে বারবার আন্দোলন করেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। তার অফিস রুমে বেশ কয়েকবার তালা ঝুলিয়েছে ছাত্রলীগও। উপাচার্যের বিরুদ্ধে ওঠা অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তের লক্ষ্যে গঠিত হয় ইউজিসির তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি। এ কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন ইউজিসির তৎকালীন সদস্য বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহের।

নিজস্ব বাসায় বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় সিকিউরিটি

উপাচার্য শেখ আবদুস সালাম দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ঢাকার কেরানীগঞ্জে ব্যক্তিগতভাবে নির্মাণাধীন বিল্ডিংয়ের কাজ তদারকির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থে এলিট ফোর্সেস লিমিটেড থেকে তিনজন সিকিউরিটি গার্ড নিযুক্ত করেন। তাদের বেতন বাবদ প্রতি মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয় হয় ৪০ হাজার ৫০০ টাকা। তাদের অন্যান্য আর্থিক সুবিধাও দেওয়া হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের টাকায়। 

ইউজিসি তদন্ত প্রতিবেদনে কী সুপারিশ করেছে, তা আমার জানা নেই। তবে আমার বিরুদ্ধে আসা সব অভিযোগ মিথ্যা।

- অধ্যাপক শেখ আবদুস সালাম, উপাচার্য, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।

ইউজিসি তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যক্তিগত কাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থে জনবল নিয়োগ আর্থিক শৃঙ্খলা পরিপন্থি। তাই এখন পর্যন্ত এসব সিকিউরিটির পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়ের যত টাকা খরচ হয়েছে, তা ভিসির ব্যক্তিগত তহবিল থেকে আদায় করার সুপারিশ করেছে কমিটি। 

উপাচার্যের ৯টি অডিও ফাঁস

বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দায়িত্ব পালনকালে উপাচার্য আবদুস সালামের নানা অনিয়ম-দুর্নীতির ৯টি অডিও ফাঁস হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে। এসব অডিওতে নিয়োগ, প্রশ্নফাঁস ও নিয়োগের বিষয়ে টাকা আদানপ্রদানের মতো স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ ছিল। 

ইউজিসির তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব অডিও যদি ভিসির ব্যক্তিগত কথোপকথন হিসেবে পরিগণিত হয়, তবে তার দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। এই অডিওগুলো ভিসির নিজের কথোপকথন কি না, তা নিশ্চিত হতে সাউন্ড বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নেওয়া জরুরি।

৫৩৭ কোটি টাকার মেগাপ্রকল্পে নয়ছয়

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫৩৭ কোটি টাকার মেগাপ্রকল্পের মাধ্যমে ৯টি দশতলাবিশিষ্ট ভবন করা হচ্ছে। এর মধ্যে তিনটি ছাত্র হল, দুইটি ছাত্রী হল, একটি করে প্রশাসনিক ও একাডেমিক ভবন, দুইটি শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য আবাসিক ভবন। প্রকল্প অনুমোদনের সময় বিল্ডিংগুলোর পাইলিংয়ের দৈর্ঘ্য হওয়ার কথা ছিল ৫০-৬০ ফুট। অথচ করা হয়েছে ৪০ ফুট। এ ছাড়াও বিল্ডিংগুলোর টেন্ডারের তথ্য ফাঁস, ড্রয়িং অনুযায়ী কাজ না হওয়ার অভিযোগ রয়েছে ভিসির বিরুদ্ধে। 

ইউজিসিও নানা তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এর প্রমাণ পেয়েছে। প্রতিবেদনে ইউজিসি বলছে, নতুন ভবনের পাইলিংয়ের দৈর্ঘ্য কমানো হয়েছে। বিল্ডিং ডিজাইনে পাইলিং যেভাবে করার কথা ছিল, সেভাবে তা করা হয়নি। ৫৩৭ কোটি টাকার এ মেগাপ্রকল্পের বাস্তবায়নকারী সংস্থা হচ্ছে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন ও কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। কমিশন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতামত না নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিজস্ব উদ্যোগে অনুমোদিত বিল্ডিং ডিজাইন পাল্টিয়ে পাইলিংয়ের দৈর্ঘ্য কমিয়েছে। কমিশনের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগকে বিষয়টি জানানোই হয়নি।

তদন্ত কমিটি দেখতে পেয়েছে, বিল্ডিংয়ের পাইলিংয়ের রি-ডিজাইন করার ক্ষেত্রে সয়েল টেস্ট, লোড ক্যাপাসিটি এবং বিল্ডিং ডিজাইনের স্থায়িত্ব ও নিরাপত্তা বিধানের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাঠানো তথ্য যথাযথ নয়। কমিটি তাই মনে করে, দৈর্ঘ্য কমানো পাইলগুলো ভবনের লোড নিতে পারবে কি না, তা তদন্ত করে দেখা দরকার। এক্ষেত্রে বিশেষ পদ্ধতিতে (নন ডেসট্রাকটিভ ওয়ে) বিশেষজ্ঞ সিভিল ইঞ্জিনিয়ার সমন্বয়ে একটি স্বাধীন বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে ভবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা উচিত বলেও সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। 

ভুয়া বিলে সোয়া ছয় কোটি টাকা আত্মসাৎ

‘ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন তৃতীয় পর্যায়’ শীর্ষক প্রকল্পের দ্বিতীয় প্রশাসন ভবনের সর্বশেষ চলতি বিলে দুটি আইটেমে ভুয়া বিল দিয়ে ৬ কোটি ২৫ লাখ ২০ হাজার ৭৬ টাকা তুলে আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশলী, প্রকল্প পরিচালক, ঠিকাদারসহ একাধিক কর্মকর্তা ও কয়েকজন সাবেক-বর্তমান ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে এ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

ইউজিসির তদন্ত কমিটিও বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজের জন্য রডের পরিমাণ বাড়িয়ে মোট ৬ কোটি ২৫ লাখ ২০ হাজার ৭৬ টাকা বিল দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে একটি বিশেষায়িত তদন্ত কমিটি গঠন করে অভিযোগের সত্যতা যাচাই জরুরি। 

অতিরিক্ত নিয়োগ ও উচ্চতর বেতন স্কেল অনুমোদন

উপপরিচালকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা পদে অনুমোদিত পদের চেয়েও বেশি পদোন্নতি/পদোন্নয়ন দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে উপাচার্য ড. আবদুস সালামের বিরুদ্ধে। 

এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ২০২২ সালের ৯ আগস্ট অনুষ্ঠিত ২৫৫তম সিন্ডিকেট সভায় শর্ত সাপেক্ষে বেতন বাড়ানোর অর্থাৎ উচ্চতর বেতন স্কেল প্রদানের অনুমোদন দেয়। যা জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫ এবং সরকারের আর্থিক শৃঙ্খলা পরিপন্থি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স কমিটি বা সিন্ডিকেটের এ ধরনের অনুমোদন দেওয়ার ক্ষমতা নেই।

এসব ব্যাপারে ইউজিসির তদন্ত কমিটি বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের অনুমোদনক্রমে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উচ্চতর বেতন স্কেল এবং অনুমোদিত পদের চেয়ে উপপরিচালক/সমমান পদে পদোন্নয়ন/পদোন্নতি দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের বিধিবিধান প্রতিপালন করা আবশ্যক। অথচ সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে সরকারি বিধিবিধান অগ্রাহ্য করা হয়েছে। এক্ষেত্রে আর্থিক শৃঙ্খলা আনয়নের জন্য সরকারি বিধিবিধান অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা

এসব প্রসঙ্গে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. শেখ আবদুস সালাম বলেন, ‘ইউজিসি তদন্ত প্রতিবেদনে কী সুপারিশ করেছে, তা আমার জানা নেই। তবে আমার বিরুদ্ধে আসা সব অভিযোগ মিথ্যা। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এগুলো করা হয়েছে।’

ইউজিসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, ‘তদন্ত শেষে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সুপারিশসহ প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয় পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে।’ 

(খবর প্রতিদিনের বাংলাদেশের)